বিএনপি ও সমমনা দলগুলো সরকারের পদত্যাগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারসহ বিভিন্ন দাবিতে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছে। তবে ঢাকা মহানগরের এবারও বিএনপির প্রস্তুতি নানা সমালোচনা হচ্ছে। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গণসমাবেশসহ পরবর্তী কর্মসূচিগুলোতে দলটির হাইকমান্ডও মহানগরের কম সংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে । সর্বশেষ বৃহস্পতিবারের স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও দলের অভ্যন্তরীণ নানা সমস্যা, সন্দেহসহ বেশ কিছু বিষয় নিয়ে বৈঠক করা হয়েছে। সেখানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক আমানউল্লাহ আমানকে নিয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা হয়। বৈঠকে গুলশান কার্যালয়ে ১৫ সংগঠনের আত্মপ্রকাশ ও আন্দোলন নিয়ে ‘বিতর্কিত’ বক্তব্যের পেছনে তার উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন স্থায়ী কমিটির নেতারা। এছাড়া নয়াপল্টনে চার শতাধিক নেতা-কর্মী গ্রেফতার হলেও প্রথমেই আমানের জামিন নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা।
স্থায়ী কমিটির ওই বৈঠকে নেতারা জানান, ক্ষমতাসীনদের নানা বাধার পরও গত কয়েক মাসে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন সফল করেছে বিএনপি। এতে সারাদেশের নেতাকর্মী ও সাধারণ সমর্থকদের মাঝে চূড়ান্ত আন্দোলনের মানসিকতা তৈরি হয়েছে। বিগত দিনের মতো তৃণমূলের নেতাকর্মীরাও চূড়ান্ত আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু গত ১০ ডিসেম্বর গোলাপবাগের বিভাগীয় গণসমাবেশ এবং ১১ জানুয়ারি গণ-অবস্থান কর্মসূচিতে ঢাকার প্রস্তুতি মনোপূত হয়নি। আগামী দিনে কী কর্মসূচি নেওয়া যায়, সে বিষয়টিও ওঠে বৈঠকে। ঢাকাকে প্রস্তুত করে সরকার পতনের এক দফার চূড়ান্ত আন্দোলনে যেতে মত দেন নেতারা। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারকের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। এ বিষয়ে জানতে আমানউল্লাহ আমানকে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি। এছাড়া বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী কমিটির একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা হলেও তারা বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সভাপতিত্বে বৃহস্পতিবার স্থায়ী কমিটির ভার্চুয়াল বৈঠক হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক নীতিনির্ধারক জানান, বৈঠকে আমানের বক্তব্যসহ নানা বিষয়ে দীর্ঘ সময় আলোচনা হয়। বিশেষ করে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও মির্জা আব্বাসের গ্রেফতার এবং নয়াপল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে পুলিশের অভিযানসহ নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে এই বৈঠকে। এতে গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৫ সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত জোট নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হয়।
সূত্রমতে, বৈঠকে গত ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের আগে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আমান উল্লাহ আমানসহ বেশ কয়েকজন নেতার বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়। এক অনুষ্ঠানে আমান বলেছিলেন, ‘১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার কথায়’। ওই বক্তব্যের পর সরকার ভয় পেয়ে যান বলে মনে করেন বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। যদিও এ বক্তব্যের পর আমান উল্লাহ আমানকে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ডেকে সতর্ক করেছিলেন। আবারও সেই বিষয়টি স্থায়ী কমিটির বৈঠকে উঠে আসে। বৈঠকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে এক নেতা বলেন, গ্রেফতার হয়েছি কিনা তখনও জানতাম না। কিন্তু ডিবি অফিসে তার কাছে গল্পের ছলে জানতে চাওয়া হয়, আমরা বসে যাব কিনা? যতবারই বলেছি, তাদের এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেই। থাকলে আমি জানতাম। অন্যান্য বিভাগীয় গণসমাবেশের মতোই এটা একটি গণসমাবেশ। কিন্তু ডিবি পুলিশ কোনো অবস্থায় তা বিশ্বাস করতে চায়নি। ওই নেতা বলেন, ইলিয়াস আলী গুমের ঘটনায় মুখ ফসকে একটি বক্তব্য দিয়েছিলাম, সেই ঘটনায় আমার কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছিল। তাহলে আমানের কাছে কেন ব্যাখ্যা চাওয়া হবে না? এরপর দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিষয়টি মহাসচিবকে দেখতে বলেন। বৈঠকে ওই নেতা আরও বলেন, সরকারের লোকজন সঙ্গে নিয়ে তো আর সরকার বিরোধী আন্দোলন করা যাবে না। যার কথাকে কেন্দ্র করে সবাই গ্রেফতার হয়েছেন, তাকেই আবার কারাগারে নেওয়ার আগে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে সাধারণ নেতাকর্মীদের মাঝে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এটা পরিষ্কার হওয়া দরকার।
সূত্রমতে, স্থায়ী কমিটির এ বৈঠকের আগে বুধবার নয়াপল্টনে গণঅবস্থান কর্মসূচিতে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির আহ্বায়ক আমান উল্লাহ আমান সভাপতিত্ব করেননি। আগের দিন বিএনপি থেকে জানানো হয়েছিল গণঅবস্থান কর্মসূচিতে অন্যদের সঙ্গে পরিচালনায় থাকবেন আমানউল্লাহ আমান। এরপর থেকে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে। এ অবস্থায় তা আরো জোরালো হয়, গণ-অবস্থানে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির নেতাকর্মী উপস্থিতি দেখতে চান দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সে অনুযায়ী বিশেষ অতিথি হিসেবে মির্জা আব্বাস যখন বক্তব্য দিচ্ছিলেন, তখন দলের কেন্দ্রীয় একজন নেতা লাইভে বিস্তারিত দেখান। তখন ঢাকা মহানগরের উত্তরের নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল খুবই কম।
সূত্র আরও জানায়, ১৫ সংগঠন নিয়ে জোট করল কে? এ প্রশ্নও ওঠে স্থায়ী কমিটির বৈঠকে। ২০ দলীয় জোট ভেঙে দেওয়া, আবার গুলশানে চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ে ১৫ সংগঠনের সমন্বয়ে জোট করা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের উদ্দেশে স্থায়ী কমিটির একজন নেতা জানতে চান, এটা কেমন হলো, আমরা জোট ভেঙে দিলাম, আবার গুলশান কার্যালয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবমুখী ১৫ সংগঠন নিয়ে একটি জোট গঠন করলাম-এটা কেমন বার্তা গেল? এ সময় স্থায়ী কমিটির আরেক নেতা বলেন, একটি বিষয়ে ফোকাস করা দরকার। ছোট ছোট দল নিয়ে গুলশান অফিসে একটি জোট হয়েছে। আসলে এগুলো কোনো রাজনৈতিক দল নয়। এ জন্যই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের ৫৪ দলের ৫৪টি ঘোড়ার ডিম পাড়ার মতো মন্তব্য করার সুযোগ পেয়েছেন। এটা কারা করছে, কীভাবে করছে? এর একটা বিহিত হওয়া প্রয়োজন। এ জোট আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু থাকলেও তিনি এ বিষয়ে জানতেন না। আমান উল্লাহ আমানের তত্ত্বাবধানে হয়েছে। একজন নেতা জানতে চান, আমানকে দলের অথরিটি কে দিয়েছে? এ সময় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানও বলেন, তাকেও এ জোট গঠনের বিষয়ে অবহিত করা হয়নি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন নেতা ও একজন ভাইস চেয়ারম্যান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা মহানগরের সমস্যা সমাধান এবং দলের সন্দেহভাজন নেতাদের দূরে রেখে আন্দোলনের পরিকল্পনা করলেই সফলতা আসবে। ২০১৪ সালের আন্দোলন ঢাকার নেতাদের জন্য ব্যর্থ হয়েছে। এবার সেই ঢাকাকে ঠিক করেই আন্দোলনে যেতে হবে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগর বিএনপি এবং দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের ঢাকা মহানগর কমিটির নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে দলের শীর্ষ নেতা দ্রুত কঠোর আন্দোলনে যাওয়ার ইঙ্গিত দেন। ২ জানুয়ারি বিএনপির আন্দোলনের ১০ ও রাষ্ট্র মেরামতের ২৭ দফা রূপরেখার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ আলোচনায় দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনও মার্চে কঠোর আন্দোলনের ইঙ্গিত দেন। নেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেন, সময় বেশি নেই, অপেক্ষা করা যাবে না। আন্দোলনের জন্য ফেব্রুয়ারি, বেশি হলে মার্চের মাঝামাঝি নেতাকর্মীদের জন্য পরীক্ষা।
বিএনপি নেতারা বলেন, মার্চে রোজা শুরু, এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে ঈদ। এরপর বর্ষাকাল ও কুরবানির ঈদ উদযাপনের মাধ্যমে জুলাই মাস চলে আসবে। এ সময় তেমন কোনো কর্মসূচি পালন করা যাবে না। এমন পরিস্থিতিতে বেশির ভাগ নেতা মার্চে চূড়ান্ত আন্দোলনে নামার পক্ষে মত দিয়েছেন। নেতারা মনে করেন, মার্চে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট তীব্র হতে পারে। ডলারের দাম বাড়তে পারে। ওই সময় গরম বাড়ায় বিদ্যুতের চাহিদা বাড়বে। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে চাহিদা মতো জ্বালানি আমদানি করতে না পারলে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির অবনতি হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বাড়তে থাকবে। এতে মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। তখন জোরালো কর্মসূচি দিলে মানুষের ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে আন্দোলন সফল করা যাবে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এ সরকারের অধীনে কোনো কিছু নিরাপদ নয় তা দেশের মানুষ মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই গত তিন-চার মাস ধরে এ সরকারের অন্যায় অত্যাচারের পরও দেশের মানুষ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। এ অবস্থায় প্রশ্নটা হচ্ছে চূড়ান্ত আন্দোলন কবে? আমি বলব, চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হয়েছে। তবে আন্দোলনের ফলাফল কবে আসবে সেটা বলতে পারি না। যতক্ষণ পর্যন্ত ফলাফল না হবে, ততক্ষণ চূড়ান্ত আন্দোলন প্রমাণ হয় না। এ আন্দোলনের গতি ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে, একসময় সফলতার মুখ দেখবে।