বার্ষিক কর্মকৃতি মূল্যায়ন বিধিমালার খসড়া প্রস্তুত

Ministry-of-public-affairs-dainik-bhashwakar
Spread the love

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদনের (এসিআর) পরিবর্তে বার্ষিক কর্মকৃতি মূল্যায়ন পদ্ধতি (এপিএআর) প্রবর্তন হচ্ছে। এই পদ্ধতিতে সব কর্মকর্তার কর্মকৃতির মূল্যায়ন অনলাইন প্রোফাইল উপস্থাপন করতে হবে। কেউ ইচ্ছে করলে কারও এপিএআর পরিবর্তন করতে পারবেন না। ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অনলাইনে কে কি কাজের জন্য কত নম্বর পেয়েছে, কোন বিষয়ে সে বিশেষ জ্ঞান অর্জন করল তার রেকর্ডও অনলাইনে সংরক্ষিত হবে।

সুতরাং এসিআরের ন্যায় এপিএআরের জালিয়াতির কোনো সুযোগই থাকবে না। এপিএআর এসিআরের স্থলাভিষিক্ত হবে। এজন্য একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।

এসিআর নিয়ে কর্মকর্তাদের অভিযোগের কোনো শেষ ছিল না। এসিআর দেওয়া হতো গোপনে। কর্মঠ, পরিশ্রমী, ন্যায়পরায়ণ, সৎ এবং অপেক্ষাকৃত সৎ কর্মকর্তা জানতেন না তাকে কত নম্বর দেওয়া হয়েছে। ভালো কর্মকর্তাদের এসিআরে কম নম্বর দেওয়া, বিশেষ সুবিধার বিনিময়ে এসিআরে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, এসিআর না দিয়ে কর্মস্থল পরিবর্তন করা, অধস্তনদের এসিআরে কম নম্বর দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অপরাধ করতে বাধ্য করা, মতের বিরোধীদের এসিআরে নম্বর কম দিয়ে পদোন্নতি বঞ্চিত করা, সুন্দরীদের এসিআরে নম্বর বাড়িয়ে দেওয়া, ঘষামাঝা করে প্রাপ্ত নম্বর কমানো কিংবা বাড়ানোর অভিযোগ ছিল। এসিআর নিয়ন্ত্রণকারীদের বিরুদ্ধেও ছিল নানা অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ।

এসব অভিযোগ থেকে বেরিয়ে একটি স্বচ্ছ, প্রত্যক্ষ, যুগপোযোগী পদ্ধতির প্রচলনের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বিগত প্রায় ১০ বছর ধরে বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে গবেষণা করে। প্রথমদিকে এসিআর’র পরিবর্তে অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স রিপোর্ট (এপিআর) করার সিদ্ধান্ত নিয়ে কয়েক বছর গবেষণা করা হয়। তারপর সেই পদ্ধতি বাদ দিয়ে গত প্রায় ৩ বছর ধরে বার্ষিক কর্মকৃতি মূল্যায়ন (এপিএআর) নিয়ে কাজ করছে মন্ত্রণালয়টি।

কেন এসিআর এপিএআর অ্যানুয়াল পারফরম্যান্স অ্যাপ্রেইজাল রিপোর্ট হলো সে বিষয়ে সরকারের অতিরিক্ত, যুগ্ম ও উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভিন্ন কথা। খোদ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কর্মরত কর্মকর্তারাই বলছেন বিষয়টির সঙ্গে তারা এখনও তেমন কোনো ভাবে পরিচিত হয়ে উঠতে পারেননি। তবে সব স্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বিষয়টি অবশ্যই এসিআরের চেয়ে ভালো হবে মনে হচ্ছে। কারণ এখান কাজ ও নম্বর দুটোই উন্মুক্ত থাকবে।

নতুন এই পদ্ধতি চালুর লক্ষ্যে একটি খসড়া বিধিমালা তৈরি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। যা কর্মকৃর্তি মূল্যায়ন বিধিমালা ২০২২ নামে অভিহিত হবে। এই পদ্ধতিতে বছরের শুরুতেই কর্মবণ্টন অনুযায়ী একজন কর্মকর্তা নিজে করবেন এমন এক বছরের কাজের একটি কর্মপরিকল্পনা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে পেশ করবেন।

ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা চাইলে কাজের পরিমাণ বাড়াতে কিংবা কমাতে পারবেন। বছরের বিভিন্ন সময় কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নে অধস্তন কর্মকর্তাকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নানা পরামর্শ, সহযোগিতা, সমর্থন ও প্রেরণা দেবেন। বছর শেষে পরিকল্পনার কত শতাংশ কাজ সে নিজে করতে পারল তা নিজেই মূল্যায়ন করবে। যা স্ব-মূল্যায়ন বিবেচতি হবে। তিনি নিজের কাজের ওপর কতটা সন্তুষ্ট এবং কতটা অতৃপ্ত তা উল্লেখ করে নিজেই নম্বর দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছে মূল্যায়নের জন্য পেশ করবে।

এপিএআর ১০০ নাম্বারে মূল্যায়ন হবে। এক বছরের কাজের মূল্যায়ন হবে ৬০ নম্বরে। মূল্যায়নকারী নম্বর দিয়ে প্রতি স্বাক্ষরকারী কর্মকর্তার কাছে পেশ করবেন। প্রতি স্বাক্ষরকারী প্রাপ্ত নম্বর থেকে ১০ কমাতে কিংবা ১ থেকে ১০ মার্ক যোগ করতে পারবেন। কেন কমানো কিংবা বাড়ানো হলো তার বিস্তারিত বিবরণ থাকবে ইলেকট্রনিক পদ্ধতি অনলাইনে। কোনো ধরনের ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকবে না।

বাকি ৪০ নম্বর দেওয়া হবে ব্যক্তিগত ও পেশাগত বৈশিষ্ট্যের জন্য। ব্যক্তিগত ও পেশাগত বৈশিষ্ট্যের বিষয়ে বিধিমালার খসড়ায় বলা হয়, সেবাগ্রহীতা ও অংশীজনদের সঙ্গে ভদ্রোচিত আচরণ এবং আন্তরিকতার সঙ্গে সেবা প্রদান ব্যক্তিগত বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হবে। পেশাগত বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম হবে দাপ্তরিক দায়িত্ব, কার‌্যাবলির কৌশল, প্রযুক্তি, আইন, বিধিবিধান ও প্রক্রিয়ার বিষয়ে জ্ঞান।

এছাড়া সেবা প্রদানে দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং যুক্তি উপস্থাপনে দক্ষতা পেশাগত বৈশিষ্ট্য হিসাবে বিবেচিত হবে। কর্মকর্তার স্ব-মূল্যায়িত নম্বর এবং ব্যক্তিগত ও পেশাগত বৈশিষ্ট্যের জন্য মূল্যায়নকারীর দেওয়া নম্বর যোগ হয়ে প্রাথমিক এপিএআর নম্বর গণনা শুরু হবে। যা প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্মকর্তার দেওয়া নম্বরে চূড়ান্ত হবে।

খসড়া বিধিমালায় বলা হয়, নবম গ্রেড তদূর্ধ্ব কর্মকর্তারা এই পদ্ধতির আওতায় আসবেন। দশম গ্রেড থেকে ২০ গ্রেড পর্যন্ত কর্মচারীদের জন্য সরকার চাইলে এই পদ্ধতি অথবা ভিন্ন কোনো পদ্ধতি চালু করতে পারবে। কোনো কর্মকর্তা কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে টানা ৯ মাসের বেশি কাজ করলে তার এপিএআর দাখিল করা বাধ্যতামূলক। তবে ৩ মাসের কম কোনো কর্মকর্তা কোনো কর্তৃপক্ষের অধীনে কাজ করলে তাকে এপিএআর দাখিল করতে হবে না। কোনো কর্মকর্তা এপিএআর দাখিল না করলে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সরকার চাইলে কোনো নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এপিএআরের পাশাপাশি এসিআরও চালু রাখতে পারবে।

এ বিষয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং ও প্রশিক্ষণ (সিপিটি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ড. মো. সহিদউল্যাহ যুগান্তরকে বলেন, এসিআর এবং এপিএআরের মধ্যে বিস্তর তফাৎ রয়েছে। আগে হাতে লিখে এসিআর দেওয়া হতো। এখন সম্পূর্ণ ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে এপিএআর সাবমিট করতে হবে। এসিআর গোপনে দেওয়া হতো। এখানে সব প্রকাশ্যে। এসিআরে কোনো কর্মপরিকল্পনা ছিল না। এপিএআরে এক বছরের কর্মপরিকল্পনা থাকছে। ৫ বছর পর একজন কর্মকর্তার প্রোফাইল চেক করলে দেখা যাবে সে কোন বিষয়ে এক্সপার্ট হয়েছে। সে যে বিষয়ে এক্সপার্ট সরকার তাকে ওই সংশ্লিষ্ট পদে পোস্টিং দেবে।

তিনি আরও বলেন, প্রশাসনিক উন্নয়নসংক্রান্ত সচিব কমিটির পরামর্শে আমরা বিধিমালাটি প্রস্তুত করে মতামত নিয়েছি। শিগগিরই প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটিতে অনুমোদনের জন্য পাঠাব। ওই কমিটিতে পাঠাতে আর কোনো আনুষ্ঠানিকতা বাকি নেই বলেও জানান তিনি।

খসড়া বিধিমালা অনুসারে, ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে অনলাইন সফটওয়্যার সিস্টেমে এপিএআর ব্যবস্থাপনা করা হবে। কর্মপারকল্পনা দাখিল, স্ব-মূল্যায়ন, মূল্যায়ন, প্রতিস্বাক্ষর, সংরক্ষণসহ সব কার্যক্রম অনলাইনে সম্পন্ন হবে। এই সিস্টেম জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এক মন্ত্রণালয় অন্য মন্ত্রণালয়ের এপিএআর সম্পর্কিত তথ্যভান্ডারে প্রবেশ করতে পারবে না। তবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পদোন্নতি, পদায়ন প্রেষণ অনুবিভাগের জন্য এপিএআর তথ্যভান্ডার ব্যবহারের সুযোগ থাকবে। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব/সচিবরা কিংবা সংস্থা প্রধানরা ড্যাশবোর্ডের মাধ্যমে এপিএআরের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন।

বিধিমালার খসড়ায় বলা হয়, সব সরকারি কর্মচারী, স্বায়ত্তশাসিত ও বিধিবদ্ধ সংস্থা, করপোরেশন, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কমিশন এবং অসামরিক কর্মচারীদের মধ্যে ইতঃপূর্বে যাদের জন্য এসিআর প্রযোজ্য ছিল, ঠিক তাদের ক্ষেত্রেই এপিএআর প্রযোজ্য হবে।

প্রতি বছর ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে স্ব-মূল্যায়িত অংশিক কিংবা বাৎসরিক এপিএআর মূল্যায়নের জন্য প্রোফাইলে উপস্থাপন করতে হবে। মূল্যায়নকারী স্বাক্ষর করে ৩১ আগস্টের মধ্যে প্রতিস্বাক্ষরকারী কর্মকর্তার কাছে পাঠাবে। প্রতিস্বাক্ষরকারী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে এপিএআর ব্যবস্থাপনা ইউনিটে পাঠাবে। তবে অতিমারি, মহামারি, দৈব-দুর্বিপাক কিংবা অনিবার্য পরিস্থিতির কারণে এপিএআর দাখিল করতে ব্যর্থ হলে, সরকার বিশেষ বিবেচনায় এই সময়সীমা পুনর্নির্ধারণ করবে।

বিধিমালার খসড়ায় উল্লেখ করা হয়, এপিএআরের কোনো তথ্য পরিবর্তন হলে পরবর্তী এক মাসের মধ্যে তা প্রোফাইলে হালনাগাদ করতে হবে। প্রতি ৩ বছর পর পর এপিএআর দাখিলের সময় কর্মকর্তাদের সদ্য তোলা ছবি সংযোজন করতে হবে।

এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে বিভিন্ন দপ্তর/সংস্থায় কর্মরতদের এপিএআর দাখিলের বিষয়ে খসড়া বিধিমালায় বলা হয়, অধিক্ষেত্র নির্দিষ্ট একটি জেলায় হলে জেলা প্রশাসক (ডিসি) ম্যাজিস্ট্রেটের এপিএআর মূলায়ন করবে। প্রতিস্বাক্ষর করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব অথবা সচিব। অধিক্ষেত্রে একই বিভাগের একাধিক জেলায় হলে ওই বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার এপিএআর মূল্যায়ন করবে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব অথবা সচিবর প্রতিস্বাক্ষর করবেন।

অধিক্ষেত্রে দুই বিভাগ হলে দুই বিভাগীয় কমিশনার ম্যাজিস্ট্রেটের এপিএআর মূল্যায়ন করবে এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বা সচিব প্রতিস্বাক্ষর করবে। অধিক্ষেত্রে সারা দেশ হলে ম্যাজিস্ট্রেটের এপিএআর মূল্যায়ন করবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব অথবা সচিব। দপ্তর সংস্থা প্রধানদের এপিএআর মূল্যায়ন করবে মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কিংবা সচিব এবং প্রতিস্বাক্ষর করবেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা উপমন্ত্রীরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *