সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা আন্দোলনের তীব্রতা এই মুহূর্তে কিছুটা কমলেও যে কোনো সময় ফের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে-এমন আশঙ্কা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র শিবির নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তে দলটির নেতাকর্মীরা মরণ কামড় দিয়ে মাঠে নামতে পারেন। এসব বিষয় মাথায় রেখে নিরাপত্তা ছক তৈরি করেছে পুলিশ। নিজ নিজ এলাকাকে নিরাপদ রাখতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর থেকে কোন ধরনের সাপোর্ট প্রয়োজন, তা দ্রুত জানাতে আটটি অপরাধ বিভাগের উপকমিশনারকে (ডিসি) নির্দেশ দেওয়া হয়। ওই নির্দেশ পাওয়ার পর ইতোমধ্যেই ডিসিরা নিরাপত্তাসংক্রান্ত তাদের চাহিদার কথা ডিএমপির অপারেশন বিভাগকে জানিয়েছেন। সে অনুযায়ী কার্যক্রম শুরু করেছে ডিএমপি সদর দপ্তর। এক্ষেত্রে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে, আন্দোলনের সময় তারা যেন অলিগলিতে না ঢোকেন। সর্বশক্তি দিয়ে যেন মূল রাস্তা সচল রাখার চেষ্টা করেন। সাম্প্রতিক সহিংসতার সময় দেখা গেছে, মূল রাস্তার একপাশ দখলমুক্ত করতে গেলে আন্দোলনকারীরা অন্য পাশ (যে অংশ পুলিশের দখলে ছিল) দখল করে ফেলে। তাই কোনো অংশ নতুন করে দখলমুক্ত করতে গেলে সব পুলিশ সদস্য যেন একসঙ্গে মুভ না করেন। আগে থেকেই পুলিশের দখলে থাকা অংশে যেন কিছু পুলিশ সদস্য পাহারায় থাকেন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে যে ভয়াবহ নাশকতা হয়েছে, তা ছিল তাদের কল্পনার বাইরে। সেতু ভবনের চারতলায় ঢুকে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ করা হবে, বিটিভি ভবন দখল করে সম্প্রচার বন্ধ করে দেবে, মেট্রোরেল-এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ধ্বংস করবে, আইডি কার্ড চেক করে করে পুলিশকে হত্যা করে লাশ ঝুলিয়ে রাখা হবে-এসব বিষয় আমরা ভাবতেই পারিনি। তারা যে একযোগে ঢাকার ৪২টি স্পট দখল করে নেবে সেটাও সংশ্লিষ্ট কারও ভাবনায় ছিল না। কারণ, অতীতে ঢাকার আন্দোলন হয়েছে পল্টন এবং রমনা এলাকায়। সে অনুযায়ী আমাদের প্রস্তুতি ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, তারা আওয়ামী লীগ অফিসে ভাঙচুর চালাতে পারে। সর্বোচ্চ থানায় থানায় গিয়ে ঢিল ছুড়তে পারে। আমরা সে অনুযায়ী প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। আমাদের প্রস্তুতির চেয়ে অনেক বেশি প্রস্তুতি নিয়ে নাশকতাকারীরা মাঠে নেমেছিল। তাই দ্রুততম সময়ে আন্দোলন চলে যায় পুলিশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
পুলিশ কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ছাত্র আন্দোলন শেষের দিকে ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সেটি চলে যায় জামায়াত-শিবিরের দখলে। সুযোগ সন্ধানী মহল এখনো বসে নেই। তারা যে কোনো সময় অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটাতে তৎপর। কিন্তু এবার মাঠে নামলে তারা সুবিধা করতে পারবে না। সাম্প্রতিক সহিংসতার ঘটনা থেকে আমরা শিক্ষা নিয়েছি। সে অনুযায়ী নিরাপত্তা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। ওই কর্মকর্তা জানান, চলমান ছাত্র অন্দোলনে প্রথম হত্যার ঘটনা ঘটে ১৭ জুলাই। ওইদিন সায়েন্স ল্যাব এলাকায় দুজন নিহত হন। একজন ছাত্রলীগ কর্মী এবং অন্যজন পাপোশ ব্যবসায়ী। ওই দুজনকে পিটিয়ে খুন করে আন্দোলনকারীরা। ১৮ জুলাই পর্যন্ত পুলিশ একটি গুলিও করেনি। ওইদিন উত্তরায় অমীত নামে একজন র্যাব সদস্যকে বেধড়ক পেটানো হয়। সে এখনো মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে। অমীতের ওপর হামলার পর র্যাবের পক্ষ থেকে গুলি ছোড়া হয়। এতে ৪-৫ জন নিহত হন। এর পরদিন অন্যান্য বাহিনীর সদস্যরা মাঠে নামলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সব বাহিনীর সদস্যরাই কম-বেশি গুলি করেন।
পুলিশ সহজেই গুলি করে না-এমন মন্তব্য করে ঊর্ধ্বতন এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ২৮ অক্টোবরের ঘটনায় একজন পুলিশ সদস্য নিহত হন। আরেকজন পুলিশ সদস্য এখনো চিকিৎসাধীন। ওই সময়ও পুলিশ কোনো গুলি করেনি। এবার বাধ্য হয়েই গুলি ছুড়েছে পুলিশ। তিনি বলেন, শিক্ষার্থীরা পুলিশকে উত্তেজিত করেছিল। বোবা পুলিশ, কোটা পুলিশ বলে ব্যঙ্গ করছে। তখনও পুলিশ চুপ ছিল। যখন থানায় আক্রমণ করা হয়েছিল তখনও পুলিশ শটগান নিয়ে বসেছিল। জানতে চেয়েছে, ‘স্যার, কী করব’? যখন দেখে তারা মারা যাবে তখনই গুলি করেছে। পদস্থ ওই কর্মকর্তা বলেন, যাত্রাবাড়ী খালি করতে ১০ রাউন্ড গুলিই পুলিশের জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু চরম ধৈর্য ধরে ৪ দিন অপেক্ষা করেছিলাম। ৪৮ ঘণ্টা চেষ্টার পরও মূল স্থানে আমরা ঢুকতে পারিনি। তবুও গুলি করিনি।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, আমরা মনে করি ছাত্রদের কোটার দাবি পূরণ হয়েছে। অনেক ছাত্রকে ধরার পরও আমরা ছেড়ে দিয়েছি। তারা না বুঝে আন্দোলনে এসেছিল। কোমালমতি বাচ্চাদের কেউ যেন আর ঢাল বানাতে না পারে সেজন্য আমরা তৎপর আছি। আমরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছি। ১৮ জুলাই পর্যন্ত অনেক সহ্য করেছি। এখন আর ধৈর্য ধারণ করব না। এরই মধ্যে প্রযুক্তিগত সহযোগিতাসহ আমরা নানা প্রস্তুতি নিয়েছি। যারা নাশকতাকারী তাদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেওয়া হবে না। সবাইকে একে একে আইনের আওতায় আনব।