সুষম ও পুষ্টিকর খাবার নিশ্চিত করতে রোজায় খাবারের বাজেট কীভাবে নির্ধারণ করবেন সেটা নির্ভর করে পরিবারের সদস্য সংখ্যার উপর। যদি নিম্নমধ্যবিত্তের পরিবার হয়, যার সদস্য সংখ্যা চার এবং মাসিক উপার্জন ত্রিশ হাজার টাকা, যার খাবারের পেছনে ব্যয় দশ থেকে পনেরো হাজার টাকা। অর্থাৎ মাথাপিছু একশ টাকা করে যদি হয়, তাহলে চারজনের চারশ টাকা এবং এক মাসে ন্যূনতম বারো হাজার টাকা খরচ।
প্রতিদিন একশো টাকার ভেতরে কি করে সেহরি, রাতের খাবার এবং ইফতার করা যাবে?
সেহরি : সবার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খাবারের মিল এটি। কারণ চৌদ্দ থেকে পনেরো ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে হবে। তাই এ খাবারটি সবচেয়ে ক্যালোরি বহুল, জটিল শর্করা, উচ্চ জৈবমূল্যের আমিষ ও আঁশ বহুল হতে হবে।
সেহরি শেষ হওয়ার একটু আগেই ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস করতে হবে। যদি কোনো রোগশোক না থাকে, তাহলে একটু কালিজিরা বা কোনো হার্বস চিবিয়ে খেয়ে, এক গ্লাস পানি খেয়ে, একটি বা দুটি খেজুর খাওয়া যেতে পারে। তারপর নামাজ আদায় করে আবার পানি খেয়ে খাবার গ্রহণের প্রস্তুতি নেওয়া যেতে পারে।
খাদ্য তালিকায় লাল চালের ভাত সবচেয়ে ভালো। গ্রাম থেকে লাল চাল খুব কম দামে আনা যেতে পারে অথবা মোটা চাল গ্রহণ করা যেতে পারে। বেশি কেটে ছেঁটে চিকন করা চাল স্বাস্থ্যকর নয়। মাছ অথবা মুরগির মাংস অথবা ডিম উচ্চ জৈবমূল্যের আমিষ। সপ্তাহের সাত দিনকে ভাগ করে নিয়ে খাবারগুলোকে সাজাতে হবে। দুদিন কম মূল্যের মাছ; যেমন-পাঙাস, তেলাপিয়া, টাটকিনি। দুই থেকে তিন দিন সামুদ্রিক মাছ; যেমন-লইট্টা, পোয়া। একদিন যে কোনো ধরনের মুরগির মাংস আর একদিন ডিম অথবা ঘন ডাল রাখতে পারেন। সঙ্গে থাকতে পারে সবজি। যেমন- পেঁপে, লাউ, মুলা, ঝিঙা, জালি কুমড়া ইত্যাদি এবং একটু সালাদ ও এক টুকরো লেবু।
মাছের কেজি যদি দুইশ টাকা হয়, এক টুকরো মাছ একশ গ্রাম হলে বিশ টাকা দাম। মুরগির মাংস দাম একটু বেশি হলেও এক থেকে দুই টুকরো মাংসের দাম ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা। সামগ্রিকভাবে অন্যান্য খরচ তরকারিসহ একজনের জন্য দশ টাকা আর এক কাপ দুধের দাম দশ টাকা অর্থাৎ চল্লিশ-পঞ্চাশ টাকা।
ইফতার : সারাদিন ক্ষুধার্ত থেকে সাধারণত আমরা ইফতারিতে ভরপুর খাবার খেয়ে ফেলি, যা পেটের অস্বস্তির কারণ হয়ে যায়। স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর উপায়ে খাদ্য গ্রহণের একটি প্রধান শর্ত হলো পরিমিত, সুষম খাবার গ্রহণ এবং আস্তে আস্তে খাবার গ্রহণ।
দুটো খেজুর ও এক গ্লাস পানি ও দেশীয় ফল যেটার দাম কম; যেমন-বরই, পেয়ারা, জাম্বুরা, আমড়া, ছোট তরমুজ, পেঁপে, কলা ইত্যাদি খাদ্য তালিকায় রাখা যেতে পারে। ইফতারিতে এ খাবারগুলোই যথেষ্ট। এ ছাড়া লাল চিড়া, দই, কলা ও গুড় হতে পারে ইফতারের আদর্শ মেনু। তারপরও আমাদের বাঙালি রীতি অনুযায়ী যদি ভাজাপোড়া বা কোনো বিশেষ ধরনের খাবার গ্রহণ করতে হয়, সেটা সপ্তাহে একদিন বা পনেরো দিনে এক দিন স্বল্প পরিমাণে রাখা যেতে পারে।
রাতের খাবার : এরপর মাগরিবের নামাজের বিরতিতে গিয়ে সরাসরি রাতের খাবার খাওয়া স্বাস্থ্যসম্মত। অল্প পরিমাণ ভাত, বেশি পরিমাণ শাকসবজি এবং এক টুকরা মাছ বা এক টুকরা মুরগির মাংস সেহরির মতো বাজেট নির্ধারণ করে সালাদ, লেবুসহ খাওয়া যেতে পারে।
ঘুমানোর আগে : তারাবির নামাজ শেষে এক কাপ দুধ ও তিন-চারটি বাদাম অথবা কোষ্ঠকাঠিন্য থাকলে এক গ্লাস ইসবগুলের ভুসি অথবা চিয়া সিড অথবা তোকমা দানা পানিতে গুলে খাওয়া যেতে পারে। চেষ্টা করতে হবে তারাবির নামাজের সময় পানি সঙ্গে রাখতে, যাতে মাঝে মধ্যে পানি গ্রহণ করা যায়। ইফতার থেকে সেহরি পর্যন্ত যেন আট থেকে দশ গ্লাস পানি গ্রহণ করা হয়, সেই দিকে খেয়াল রাখতে হবে (কিডনি রোগীদের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী গ্রহণ করতে হবে)।
ইফতারিতে খেজুর এবং ফলের খরচ জনপ্রতি বিশ থেকে ত্রিশ টাকা আর রাতের খাবারের খরচ জনপ্রতি ত্রিশ থেকে পঞ্চাশ টাকা আর রাতে ঘুমানোর আগে দুধের খরচ দশ টাকা।
এভাবে রমজানে একশ থেকে ১২০/১৩০ টাকার ভেতরেই স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ সম্ভব।
অনেকেই ভাবতে পারেন, খাবারের দাম এখানে কম বলা হচ্ছে। আমি এখানে জনপ্রতি বলেছি, চারজন যদি আপনার সদস্য হয়, তাহলে চারশ টাকা খরচ হচ্ছে প্রতিদিন অর্থাৎ মাসে বারো হাজার টাকা। আপনার প্রতিদিন চারশত টাকার খাবার গ্রহণ করছেন কিনা সে ব্যাপারটা কি কখনো হিসাব করেছেন? দেখুন আমরা বাইরে এক বাটি বিরিয়ানি বা তেহারি কিনে ফেলি সেটার দাম দুই-তিনশ টাকা। বাইরের আজেবাজে ভাজাপোড়া খাবার দুই/তিনশ টাকা খরচ করে কিনে ফেলি, কিন্তু আমাদের প্রতিদিনের খাবারের খরচ কত, সেই নিয়ে আমরা কিন্তু হিসাব করি না। আপনি আপনার এবং আপনার পরিবারের পুষ্টি চাহিদা বাজেটের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে আপনাকে সচেতন হতে হবে। তাই একদিন থেকে শুরু করে এক মাসে আপনার পুষ্টিকর খাবারের পেছনে কত খরচ হলো সেটা হিসাব করতে হবে এবং অন্যান্য খরচ কমিয়ে দিয়ে হলেও পুষ্টিকর খাবারের খরচ জোগান দিতে হবে। কারণ, পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করলে রোগাক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়। এতে আপনি আপনার কর্মদক্ষতা বেশি প্রকাশ করতে পারবেন। ডাক্তারের কাছে কম যেতে হবে এবং আপনার রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে।
স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর খাবার বলতে মূলত ঘরের খাবার, দেশিয় খাবার ও সুষম খাবারকে বোঝায়। প্রতিটি খাদ্য শ্রেণির থেকেই প্রতিটি মিলের খাবার আসা জরুরি। আপনার প্রয়োজনের ওপর ভিত্তি করে সেটার পরিমাণ নির্ণয় করতে হয়।