তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান ভূ-রাজনৈতিক এবং জনসংযোগ উভয় ক্ষেত্রে দক্ষতা অর্জনের দিক থেকে যে সর্বশেষ তুর্কি নেতা, সেটা বলার ক্ষেত্রে হয়তো আরও প্রমাণের প্রয়োজন রয়েছে; কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধ যে তুরস্কের জন্য অপ্রত্যাশিত বিজয় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে, সেটা মনে হয় বলাই যেতে পারে।
এই যুদ্ধে খুব ধীরস্থির এবং বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে অগ্রসর হয়েছেন এরদোগান। এতে পশ্চিমা তথা ন্যাটো জোটের সঙ্গে সম্পর্ক কিছু খারাপ হলেও রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে উঠেছেন তিনি। আবার সম্পর্ক নষ্ট করেননি ইউক্রেনের সঙ্গেও। পাশাপাশি তুর্কি নেতা ইউক্রেন যুদ্ধে সরাসরি কোনো পক্ষ না নিয়ে পালন করছেন মধ্যস্থতার ভূমিকা। এর ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তার গ্রহণযোগ্যতা এবং ভাবমূর্তিও বেড়েছে বহুগুণ। আর এসবই তুরস্কের আগামী নির্বাচনে এরদোগানকে আরও একবার জয়ী করার ক্ষেত্রে অনেক বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে। একেই বলে ‘লাঠি না ভেঙে সাপ মারা’ তথা সম্পর্ক ঠিক রেখে স্বার্থ উদ্ধার করা।
ইউক্রেন যুদ্ধের শুরুর দিকে পুতিনের সঙ্গে এরদোগানের এতটা মাখামাখি ছিল না। তবে যুদ্ধের প্রথম দিকে রাশিয়ান বাহিনী যখন তুরস্কের বায়রাকতার ড্রোনের কারণে বারবার হোঁচট খাচ্ছিল, তখনই পুতিন বুঝেছেন এরদোগানের চাল। যেটা হয়েছিল নাগার্নো-কারাবাখ নিয়ে আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার যুদ্ধে। সেই সময় পশ্চিমা নেতারাও বারবার তার কাছে ফোন করেছেন এবং ইউক্রেনে আরও ড্রোন পাঠানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
সাবেক গোয়েন্দা পুতিনের বুঝতে সমস্যা হয়নি, কী করতে হবে। এরদোগানকে মস্কো সফরের দাওয়াত দিয়েছেন। দেরি করেননি তুর্কি নেতাও, কারণ এ রকম একটা কিছুর জন্যই তো অপেক্ষা করছিলেন তিনি। গত বছর একাধিকবার রাশিয়া সফর করেছেন এরদোগান। বর্তমান সময়ে এরদোগানের মতো খুব কমই এমন নেতা রয়েছেন, যিনি প্রায় নিয়মিত ভিত্তিতে রুশ নেতার সঙ্গে কথা বলেন।
পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতর হওয়ার সুবিধা শুধু ইউক্রেনেই পাননি এরদোগান। সিরিয়াতেও রাশিয়াকে নমনীয় হতে হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর সিরিয়া থেকে অনেক সেনা ও ভাড়াটে বাহিনীর সদস্যকে সরিয়ে যুদ্ধে মোতায়েন করতে হয়েছে রাশিয়াকে। স্বাভাবিক কারণেই সিরিয়ায় তুরস্কের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে পুতিনকে। এ জন্যই সাম্প্রতিক সময়ে সিরিয়ার সঙ্গে তুরস্কের বৈরিতা ঘোচানোর উদ্যোগ নিয়েছেন রুশ নেতা।
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে থেকেই তুরস্কের অস্ত্র ব্যবসা সম্প্রসারিত হচ্ছিল। এই যুদ্ধ যেন দেশটির সেই ব্যবসার পালে হাওয়া লাগিয়েছে। বিশ্বের অনেক দেশ এখন প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে তুর্কি অস্ত্রের ক্রেতা। অন্যদিকে এরদোগান যখন রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হচ্ছেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। আঙ্কারার কাছে দুই হাজার কোটি ডলার মূল্যের এফ-১৬ যুদ্ধবিমান দেওয়ার ব্যাপারে সম্মত হয়েছে বাইডেন প্রশাসন। ইতোমধ্যে এ সংক্রান্ত প্রস্তাব কংগ্রেসে পাঠানো হয়েছে। অথচ কয়েক বছর আগে রাশিয়ার এস-৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র কেনার কারণে তুরস্ককে প্যাট্রিয়ট ক্ষেপণাস্ত্র এবং এফ-১৬ ফাইটার জেট দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছিল ওয়াশিংটন।
ইউক্রেন যুদ্ধের আগে তুরস্কের অর্থনীতি প্রায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছিল। তুর্কি মুদ্রার ব্যাপক দরপতন হয়। এরদোগান অর্থমন্ত্রী পরিবর্তন ও অন্যান্য ব্যবস্থা নিয়েও যখন কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না, তখন ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন যেন স্বস্তির বৃষ্টি হিসেবে আবির্ভূত হয় এরদোগান সরকারের জন্য।
ইউক্রেনে অভিযান চালানোর প্রতিবাদে আরোপিত শত শত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ানরা যখন কোথাও বিনিয়োগ করতে পারছিলেন না, তখন তাদের গন্তব্য হয়ে দাঁড়ায় তুরস্ক। আঙ্কারাও সেই সুযোগ দুহাতে লুফে নেয়। রাশিয়ান অলিগার্ক তথা ধনকুবেররা তুরস্কে কোটি কোটি ডলার বিনিয়োগ করেন। অপরদিকে, রুশ কোম্পানি দেশটিতে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। প্রাথমিকভাবে ৫০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা থাকলেও পরবর্তীতে আরও ১০০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এ ছাড়া তুর্কি মিডিয়ার খবর অনুযায়ী, তুরস্কের প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি বাবদ ২০০০ কোটি ডলারের বেশি পরিশোধ করবে রাশিয়া। সবকিছু মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি বিদেশি মুদ্রা প্রবেশ করবে তুরস্কে।
তুর্কি অর্থনীতিতে এরই মধ্যে যে এসব বিনিয়োগের প্রভাব পড়তে শুরু করেছে, তার প্রমাণ গত বছরের নভেম্বরের এক জরিপ। তুরস্কের একটি প্রভাবশালী পলিটিক্যাল কনসাল্টিং ফার্ম মেট্রোপল ওই সময় একটি জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা যায়, এরদোগানের ক্ষমতাসীন একে পার্টির নেতৃত্বাধীন জোটের সমর্থন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৪ দশমিক ৭ শতাংশ। অথচ একই বছরের (২০২২) জানুয়ারিতে পরিচালিত জরিপে সেটা ছিল ৩৯ দশমিক ৯ শতাংশ।