অর্থনৈতিক ইবাদত জাকাত, হিজরি ৫ম সালে তা ফরজ হয়। জাকাত একটি সুদবিহীন ও শোষণ-দারিদ্র্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের বাহন এবং ‘সামাজিক বীমা’।
০২.৫ শতাংশ জাকাত দানে ০৫ শতাংশ হারে দারিদ্র্যহ্রাস সম্ভব। পবিত্র কোরআনে জাকাতকে ‘বঞ্চিত ও মুখাপেক্ষীর অধিকার’ হিসেবে সংজ্ঞায়িত করায় প্রিয় নবী (সা.) মুয়াজকে (রা.) দেওয়া নির্দেশে বলেন, ‘এটা হচ্ছে ধনীদের কাছ থেকে গ্রহণ করে দরিদ্রদের মধ্যে বণ্টন করা।’
জাকাত অর্থ পবিত্রতা, বৃদ্ধি। ৭.৫ তোলা বা ভরি (৮৭.৪৫ গ্রাম) স্বর্ণ অথবা ৫২.৫ তোলা বা ভরি (৬১২.৫৩ গ্রাম), রৌপ্য, ব্যবসার পণ্য অথবা সমমূল্যের নগদ অর্থ যা সাংবাৎসরিক দৈনন্দিন আহার-বিহার ঘরগৃহস্থালির প্রয়োজনের অতিরিক্ত এবং তা কোনো প্রাপ্তবয়স্ক, সুস্থমস্তিষ্ক, ঋণমুক্ত, স্বাধীন মুসলমানের মালিকানায় এক বছর অতিবাহিত হলে, তার ০২.৫ শতাংশ মহান আল্লাহর সন্তুষ্টির নিয়তে সুরা তাওবার ৬০ নম্বর আয়াতে বর্ণিত খাতে অর্থাৎ ফকির, মিসকিন, নওমুসলিম, মুসাফির, জাকাত আদায়কারী কর্মচারী, ঋণগ্রস্ত, ক্রীতদাস, মুজাহিদকে ‘উপকার লাভের আশা ছাড়া’ দান করা তথা তাদের ওই সম্পদের মালিক বানিয়ে দেওয়াই জাকাত।
মুসলমানের সব ‘বৈধ ও পবিত্র’ সম্পদের জাকাত আছে। যেমন (ক) নগদ অর্থ, ব্যাংক নোট বা সঞ্চয়, শেয়ার, স্টক, (খ) উৎপাদিত ফসল, (গ) ব্যবসার মাল, অংশীদারি মূলধন, (ঘ) গৃহপালিত পশু, (ঙ) স্বর্ণ-রৌপ্য ও অলংকারাদি, (চ) খনিজ সম্পদ, গুপ্তধন ইত্যাদি। জাকাত নির্ধারণী একককে ‘নিসাব’ বলে। সম্পদের প্রকৃতি অনুযায়ী আলাদা নিসাবের বিপরীতে ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণের জাকাত ধার্য হয়।
স্বর্ণ, রৌপ্য ও নগদ অর্থকে একক নির্ধারণ করে জাকাত ধার্য করা হয়। স্বর্ণের পরিমাণ কম-বেশি হলে তার সঙ্গে নগদ অর্থ ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদকে হিসাবে এনে ওই সম্পদের আর্থিক মূল্যমান রৌপ্যের বাজার মূল্যের পরিমিত এককে হিসাব করে জাকাত আদায় করতে হবে। শুধু পরিমাণ নয়, নতুন-পুরনো স্বর্ণের বাজারমূল্যের পার্থক্য, খাদ ও তৈরির মজুরি ছাড়া নিরেট নগদ বিক্রয়মূল্যের হিসাবে জাকাত দিতে হবে।
‘অলংকার’ ব্যবহৃত বা অব্যবহৃত যেভাবেই থাক, ওগুলোর জন্য জাকাত দিতে হবে। কেননা, মহান আল্লাহ বলেন ‘যারা সোনা-রুপা সঞ্চয় করে এবং তা আল্লাহর রাস্তায় ব্যয় করে না তাদের জন্য রয়েছে যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি…’ (সুরা তাওবা, আয়াত : ৩৪, ৩৫)
এ আয়াত অবতীর্ণ হলে প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘ধ্বংস হোক স্বর্ণ, ধ্বংস হোক রৌপ্য।’ তিরমিজি শরিফে আছে, প্রিয় নবী (সা.) বলেন, ‘হে নারীসমাজ, তোমরা তোমাদের অলংকারের জাকাত দাও। কেননা, আমি তোমাদের অধিকাংশকে জাহান্নামি দেখেছি।’
আয়েশা (রা.) বর্ণিত একদা রাসুল (সা.) আমার হাতে রুপার কারুকাজ করা একটি কম্বল দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এর কি জাকাত দেওয়া হয়েছে?’ আমি বললাম, না…। তিনি বলেন, ‘এটাই তোমার জাহান্নামে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট।’ (মুস্তাদরাক)
বর্ণিত আছে, ‘যে সম্পদের জাকাত দেওয়া হয়নি তাকে বিষধর সাপে রূপান্তর করে ওই সম্পদের মালিকের গলায় জড়িয়ে দেওয়া হবে এবং সাপটি তাকে ছোবল দিতে দিতে (চুমু খাবে) বলবে : ‘আমি তোমার প্রিয় সম্পদ, গুপ্তধন…।’ (বুখারি)
হাদিসে কুদসিতে মহান আল্লাহ বলেন, ‘যে মালের জাকাত আদায় করবে, সে অবশ্যই প্রতিদান পাবে। যে আদায় করবে না, আমি তার অংশ থেকে (অন্য কোনো উপায়ে) অবশ্যই তা আদায় করে নেব।’ (আবু দাউদ)
আবু বকর (রা.)-এর খিলাফতকালে ধর্মদ্রোহী ও জাকাত অস্বীকারকারীর উদ্ভব হলে, তিনি বলেছিলেন, ‘ধর্মের ক্ষতি হবে অথচ আমি জীবিত! আল্লাহর শপথ। আমি তাদের সঙ্গে লড়েই যাব, যারা নামাজ ও জাকাতের মধ্যে পার্থক্য করে…।’ (আবু দাউদ)
এমন দৃঢ়তার জন্যই তাঁকে ‘ইসলামের ত্রাণকর্তা’ বলা হয়। তবে রাষ্ট্র প্রকাশ্য, প্রদর্শিত আয়ের জাকাত আদায় করে। অনিরূপিত, অপ্রকাশ্য সম্পদকে ইসলামে ‘আমওয়ালে বাতিনা’ বলে, এমন সম্পদের জাকাত পরিশোধ ঈমানদারের ব্যক্তিগত দায়িত্ব। রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতিতে ব্যক্তিকে নিজ উদ্যোগে জাকাত আদায় করতে হবে।
ইসলামে ‘কালো টাকা সাদা’ করার সুযোগ নেই বলেই হারাম সম্পদ-বস্তুর জাকাত দিলেই তা হালাল হয় না। জাকাত ও ট্যাক্স আলাদা এবং উভয়ের মধ্যে পার্থক্য সুস্পষ্ট। রাষ্ট্রীয় সেবা গ্রহণের কারণে ট্যাক্স পরিশোধে জাকাতের দায়মুক্তি ঘটে না।
বস্তুত ইসলামের সোনালি যুগে এমন সমাজের উত্তরণ ঘটে, সেখানে জাকাত গ্রহণের মতো দরিদ্র মানুষ খুঁজে পাওয়া যায়নি। জাকাতের উদ্দেশ্য লাখ নিঃস্বকে সম্পদের মালিক বানিয়ে দেওয়া। তাই জাকাত বাবদ নগদ টাকা দান করাই সর্বোত্তম। অথচ আমরা লাখ টাকার কোরবানি দিই! লাখ টাকায় ২৫০০ জাকাত দিই? জাকাত দেওয়া ফরজ, অস্বীকার কুফরি।