বিভাগীয় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে আন্দোলনের জোয়ার সৃষ্টি হলেও হঠাৎ করেই তাতে ছন্দপতন ঘটে। নেতাকর্মীদের মধ্যেও সৃষ্টি হয়েছে একরকম হতাশা। এমন পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে আপাতত কঠোর কর্মসূচিতে যাচ্ছে না বিএনপি।
শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করা হবে। এরই অংশ হিসাবে পদযাত্রা, বিক্ষোভ আর লংমার্চের মতো শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেতাকর্মীদের মনোবল ফের চাঙা করতে চায় দলটি। চূড়ান্ত আন্দোলনের আগে দলকে ছন্দে ফেরানোই তাদের মূল লক্ষ্য।
তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রত্যেক নেতাকর্মীকে সক্রিয় করতে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। কর্মসূচিতে সবার উপস্থিতি নিশ্চিতে দেওয়া হয়েছে বিশেষ নির্দেশনা। কেউ উপস্থিত না থাকলে তাকে কারণ দর্শাতে হবে। নেতাকর্মীদের প্রস্তুত করার পর সময় ও সুযোগ বুঝে সরকার পতনের এক দফা নিয়ে মাঠে নামবে দলটি। যদিও সমমনা দল এবং তৃণমূল থেকে বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে হাইকমান্ডের ওপর চাপ রয়েছে কঠোর কর্মসূচির। বিএনপির বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য।
আপাতত কঠোর কর্মসূচি দিচ্ছে না বিএনপি, তা দলের সিনিয়র নেতাদের বক্তব্যেও ফুটে উঠেছে। শনিবার ঢাকায় এক বিক্ষোভ সমাবেশে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ‘এবার ইউনিয়ন পর্যায় থেকে পদযাত্রা শুরু করব। এরপর ধীরে ধীরে উপজেলা, জেলা ও মহানগরে হবে।
সর্বশেষ কেন্দ্রীয় পর্যায়ে কর্মসূচি দিয়ে বর্তমান সরকারের ক্ষমতার মসনদ জনগণ দখল করে নেবে। জনগণের সরকার গঠন করবে।’
সম্প্রতি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক আলোচনাসভায় বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘অনেকে আশা করছেন আরও তীব্র গতিতে আন্দোলন চলবে। অবশ্যই হবে। আন্দোলনের একটা নির্দিষ্ট ধারা, বিজ্ঞান ও একটা নির্দিষ্ট কেমিস্ট্রি আছে। আমি বিশ্বাস করি, ইতোমধ্যে কয়েক মাসের আন্দোলনে জনগণ জেগে উঠেছে।
অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম শুরু হয়েছে। আমরা দলগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। আরও ঐক্যবদ্ধ হব। আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে জনগণই আন্দোলনের পথ দেখাবে-কোন পথে গেলে এই দানবকে পরাজিত করতে পারব।’
গত বছর বিভাগীয় গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে সরকারবিরোধী আন্দোলনের একটি গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। সরকারের নানা বাধা উপেক্ষা করে বিভাগীয় সমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বিএনপির গণসমাবেশে নেতাকর্মীদের উপস্থিতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকেও ভাবিয়ে তুলে। ঢাকার গণসমাবেশ ঘিরে সৃষ্টি হয় তুমুল উত্তেজনা।
নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা বিশ্বাস তৈরি হয়-এবার ঢাকার সমাবেশ থেকে কিছু একটা হবে। সবাই সেভাবে প্রস্তুতি নিতে থাকে। সারা দেশ থেকে নেতাকর্মীরা ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশে যোগ দেওয়ার প্রস্তুতি নিতে থাকে। কয়েকদিন আগ থেকে তারা ঢাকায় প্রবেশ করেন। ভিড় করেন নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে। কিন্ত সমাবেশের আগে ৭ ডিসেম্বর নয়াপল্টন থেকে নেতাকর্মীদের সরিয়ে দেয় পুলিশ।
এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নেতাকর্মীদের ভয়াবহ সংঘর্ষ হয়। একজন নিহত এবং কয়েকশ নেতাকর্মী আহত হন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের ভেতর ও বাইরে অভিযান চালিয়ে সিনিয়র নেতাসহ প্রায় চারশজনকে আটক করে। পরদিন আটক করা হয় দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাসকে।
কেন্দ্রীয় নেতাদের গ্রেফতারে পালটে যায় পরিস্থিতি। সরকারবিরোধী আন্দোলনের পরিবর্তে নিজেদের গ্রেফতার এড়াতেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নেতাকর্মীরা। মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙে পড়ে। বিভাগীয় গণসমাবেশের মধ্য দিয়ে সৃষ্ট আন্দোলনের গতিতে হঠাৎই ছন্দপতন ঘটে। সেখান থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে পারেনি দলটি।
জানা যায়, সরকারবিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়ে দলটির নীতিনির্ধারকদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ নিয়ে মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। কট্টরপন্থিরা চাচ্ছেন এই মুহূর্তে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হোক। কারণ, অর্থনৈতিক সংকট, দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিসহ সরকার নানা চাপে রয়েছে। কঠোর কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে সরকার আরও চাপে পড়বে। একপর্র্যায়ে তারা দাবি মেনে নিতে বাধ্য হবে। সময় পেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকার অর্থনৈতিক সংকটসহ সব চাপ মোকাবিলা করে ঘুরে দাঁড়াতে পারে। সেই সময় কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে সরকার তা মোকাবিলায় কঠোর হবে। কারণ, তাদের পিছুটান থাকবে না। তবে উদারপন্থিরা এ মুহূর্তে কঠোর আন্দোলন দেওয়ার পক্ষে নয়। তারা মনে করেন, সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে অতীতে তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে।
সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ছাড়া সরকার বা বিভিন্ন শক্তির প্রলোভনে পড়ে হটকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যার নেতিবাচক ফল আমরা পেয়েছি। কিন্তু এবার খুব ভেবে-চিন্তে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। তাছাড়া নির্বাচনের বাকি আরও প্রায় এক বছর। এত আগে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামলে তা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হবে। তাই সবকিছু প্রস্তুত করে অল্পদিনের টার্গেট নিয়ে মাঠে নামতে হবে। এর আগে নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙা করতে হবে।
একই সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সম্পর্ক আরও জোরদার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মান-অভিমান ভুলে একসঙ্গে কাজ করতে তাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করা হচ্ছে।
জানতে চাইলে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, সরকার নানাভাবে বিএনপি ও নেতাকর্মীদের উসকানি দিচ্ছে। নির্যাতন করছে। গুলি চালিয়ে হত্যা করছে। কিন্তু এরপরও তারা সরকারের ফাঁদে পা দেবে না। শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে জনগণকে আরও সম্পৃক্ত করা হবে। এর ধারাবাহিকতায় তারা কঠোর আন্দোলনে যাবেন।