অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠা রাজধানী ঢাকায় মেট্রো পাতাল রেলের নির্মাণে বেশ ঝুঁকি রয়েছে-এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের সময় সড়ক এবং এর দুপাশের দুর্বল ভবনও দেবে যেতে পারে। এ দুয়ের ব্যত্যয় ছাড়া বিশ্বের কোথাও পাতাল রেল নির্মাণের উদাহরণ নেই। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবস্থা বিবেচনায় পাতাল রেল নির্মাণ কতটা উপযোগী-এ নিয়েও আছে নানা প্রশ্ন।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত-এই পরিবহণ গণমানুষের জন্য করা হলেও প্রকল্প ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় স্বাভাবিক কারণেই এর ভাড়াও অপেক্ষাকৃত বেশি হবে। তখন সেটি আদৌ সাধারণ মানুষের পরিবহণ থাকে না। তারা বলেন, ঢাকার মাটির নরম প্রকৃতির, বর্ষার মৌসুমে জলাবদ্ধতা ও বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। ভূমিকম্পেরও বড় ঝুঁকির মুখে ঢাকা। আর্থ-সামাজিক অবস্থা বিবেচনায়ও পাতাল রেল প্রকল্প উচ্চাভিলাষী। বিপজ্জনক এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা এত সহজ হবে না। এজন্য নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য কর্তৃপক্ষকে প্রস্তুত থাকতে হবে।
এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ও জিওটেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিশেষজ্ঞ বলেন, অ্যান্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল বা পাতাল রেল নির্মাণ ঝুঁকিপূর্ণ কাজ। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সড়ক এবং আশপাশের ভবন দেবে যাওয়ার ঘটনা স্বাভাবিক। সিঙ্গাপুর ও কলকাতার ক্ষেত্রে সব প্রকল্পে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে। এ বিষয়ে কেউ যদি বলেন, কোনো ধরনের দুর্ঘটনা ছাড়াই মেট্রো পাতাল রেল নির্মাণ করবেন, সেটা অবাস্তব এবং মিথ্যা কথা। তিনি বলেন, ঢাকার মাটি নরম, হয়তো স্বাভাবিক অবস্থায় পাতাল মেট্রোরেল নির্মাণ উপযোগী নয়। তাতেও কোনো সমস্যা নেই। ওই মাটিকে উপযোগী করে নেওয়া যায়। বাংলাদেশের উত্তরা দিয়াবাড়ী এমআরটি-৬ এর ডিপো এবং রূপপুর প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সেটা করা হয়েছে। এতে প্রকল্পের খরচ অনেকাংশে বেড়ে যায়। এরপরও পাতাল রেল প্রকল্প ঢাকায় বাস্তবায়ন করতে হবে। কেননা, ঢাকার এলিভেটেড প্রকল্পগুলো থেকে কার্যকর সুফল মিলছে না। জনবহুল শহর হওয়ায় সরকারকে মেট্রো পাতাল রেল নির্মাণের কথা ভাবতে হচ্ছে। ঝুঁকি বিবেচনা করে সাবধানতার সঙ্গে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এ প্রকল্পের কাজ শুরু করতে হবে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, মাটির নিচ দিয়ে কাজ করা ঝুঁকিপূর্ণ। ঘনবসিতপূর্ণ এই শহরের ভবনগুলোও যথাযথ মান অনুযায়ী নির্মিত হয়নি। সে কারণে নির্মাণ কাজ শুরুর পর সড়কও এর দুপাশের ভবন দেবে যাওয়ার আশঙ্কা থেকে যায়। কলকাতায়ও পাতাল রেল নির্মাণের সময় এমন ঘটনা ঘটেছে।
তিনি বলেন, পাতাল রেল নির্মাণ খরচ বেশি। আর বেশি টাকা খরচ করে পাতাল রেল নির্মাণ করা হলে ভাড়াও বেশি নির্ধারণ করতে হয়। তখন এই পরিবহণ আর আমজনতার পরিবহণ থাকে না। সেজন্য এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের আগে বিকল্প কিছু থাকলে সেসব গ্রহণ করা উচিত। ঢাকায় অ্যান্ডারগ্রাউন্ড মেট্রোরেল বা পাতাল রেল নির্মাণের ক্ষেত্রে এসব বিবেচনায় রাখা হয়নি।
নগর পরিকল্পনাবিদ ও জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর অঞ্চল ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক বলেন, ঢাকার মাটি নরম। এই ধরনের মাটিতে পাতাল রেল ব্যয়বহুল। কেননা, বিদ্যমান মাটির ধরন অনুযায়ী সেটি পাতাল রেলের উপযোগী না হলেও উপযোগী করে নেওয়া যায়। সেক্ষেত্রে প্রকল্প ব্যয় কয়েকগুণ বেড়ে যায়। তখন ওই গণপরিবহণ সাধারণের নাগালের বাইরে চলে যায়।
তিনি বলেন, অনেক আগ থেকে পরিকল্পনাবিদরা ঢাকার সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে পাতাল রেল নির্মাণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু, সেসব আমলে নেয়নি। কৌশলগত পরিবহণ পরিকল্পনা বা এসটিপিতে পাতাল রেল নির্মাণের প্রস্তাবনা ছিল। সংশোধিত এসটিপিতে এটা যুক্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে কোনো স্টাডি হয়েছে বলে জানা যায় না। এখন এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে ঝুঁকিগুলো দক্ষতার সঙ্গে মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করতে হবে।
ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক জানান, দেশের প্রথম পাতাল রেল বা মেট্রো পাতাল রেল নির্মাণের ক্ষেত্রে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ‘টানেল বোরিং মেশিন-টিবিএম’ ব্যবহার করা হবে। এটা রোবোটিং প্রযুক্তি। সার্বিক দিক বিবেচনা করে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। কোনো ধরনের ঝুঁকি ও জনদুর্ভোগ ছাড়াই এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হবে। এমআরটি-৬ এর ক্ষেত্রে যেমন দুর্ভোগ হয়েছে, এক্ষেত্রে সেটিও হবে না।
জলাবদ্ধতা, বন্যা ও ভূমিকম্প মোকাবিলার বিষয়ে তিনি বলেন, যেহেতু প্রকল্পটি ঢাকায় বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, এজন্য এখানকার ঝুঁকিগুলো বিবেচনা করে প্রতিরোধ ব্যবস্থাও রাখা হবে। জাপানসহ উন্নত দেশগুলো সেসব দুর্যোগ ও ঝুঁকি যেভাবে মোকাবিলা করে ঢাকাও সেভাবেই মোকাবিলা করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২ ফেব্রুয়ারি দেশের প্রথম অ্যান্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রেল বা পাতাল রেলের নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেছেন। এমআরটি-১ নামে পরিচিত এই প্রকল্পটির দুটি অংশ। একটি বিমানবন্দর রুট আর অন্যটি পূর্বাচল রুট। বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পুরো অংশ মাটির নিচ দিয়ে যাবে। এ অংশে থাকবে ১২টি মেট্রো স্টেশন। আর অন্য অংশটি হবে এলিভেটেড। সেই অংশ নতুন বাজার থেকে কুড়িল হয়ে যাবে পূর্বাচলে। ১১ দশমিক ৩৬ কিলোমিটারের এই অংশে থাকবে ৯টি স্টেশন। প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ হবে সাড়ে ৫২ হাজার কোটি টাকা। ২০২৬ সালে দেশের প্রথম পাতাল রেলের কাজ শেষ হবে। ঢাকায় হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত যাবে এই পাতাল রেল। এমআরটি লাইন-১ হিসাবে চিহ্নিত এই প্রকল্পের দুটি অংশ। একটি হলো বিমানবন্দর রুট আর আরেকটি পূর্বাচল রুট। বিমানবন্দর থেকে কুড়িল, বাড্ডা, রামপুরা হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার পুরো অংশ হবে ভূগর্ভে। এই অংশে থাকবে ১২টি স্টেশন। মাটির ৩০ মিটার অর্থাৎ ৯০ ফুট নিচ নিয়ে নির্মাণ কাজ চালানো হবে। মালিবাগ-রাজারবাগ অংশে দুটি টিউব পাশাপাশি রাখার মতো জায়গা না থাকায় সেখানে একটি টিউবের নিচে আরেকটি টিউব বসানো হবে। এজন্য ওই জায়গায় ৭০ মিটার অর্থাৎ ২১০ ফুট মাটির নিচ দিয়ে চলবে প্রকল্পের কাজ।