নকল পোশাকের অভিযোগ: যুক্তরাষ্ট্রে পর্যালোচনার মুখে বাংলাদেশ

garments-collected
Spread the love

ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ (ইউএসটিআর) বাংলাদেশি তৈরি পোশাক পণ্যের একটি বিশেষ পর্যালোচনা শুরু করেছে। লোগোসহ বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের পোশাক রপ্তানির অভিযোগ পেয়ে তারা এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইউএসটিআর অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশকে চিঠি দিয়েছে। চিঠিটি দেরিতে আসার কারণ ব্যাখ্যা করতে সময় চেয়েছে বাংলাদেশ।

নকলের অভিযোগ ফ্রান্স ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বাণিজ্য সমিতি করেছে। ইউএসটিআর ওয়াশিংটনে ২২ ফেব্রুয়ারি এই বিষয়ে একটি খোলা শুনানি করবে৷ এই অফিসটি মেধা সম্পত্তি সুরক্ষা এবং প্রয়োগের জন্যও দায়ী। বাংলাদেশও শুনানিতে অংশ নেবে।

অভিযোগ প্রমাণিত হলে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের বিরুদ্ধে তৈরি পোশাকের ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ তিনটি শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নিতে পারে বলে মনে করেন এ খাতের নেতারা। তবে রিভিউ নিয়ে আতঙ্কের কিছু নেই বলে মনে করছেন পোশাক খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, একটি জরিপ প্রতিবেদনের তথ্য থেকে পর্যালোচনার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। এ ছাড়া ২০২৬ সাল পর্যন্ত স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ বিশেষ সুবিধা পাবে।

এই পর্যালোচনাটিকে বলা হয় ‘স্পেশাল ৩০১ রিভিউ অন আইপিআর (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস) প্রোটেকশন অ্যান্ড এনফোর্সমেন্ট’। পর্যালোচনার পর অভিযোগ প্রমাণিত হলে, বাংলাদেশি পোশাকের একক বৃহত্তম ক্রেতা যুক্তরাষ্ট্র, অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ, কোটা আরোপ বা এমনকি বাংলাদেশি তৈরি পোশাক নিষিদ্ধ করার মতো ব্যবস্থা নিতে পারে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মো. শহীদুল্লাহ আজিম কালের কণ্ঠকে বলেন, “আমি ১০০% নিশ্চিত, বিজিএমইএ সদস্যরা কোনো কপি পণ্য রপ্তানি করেন না। এ ছাড়া রপ্তানি পণ্যটি নকল কিনা তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট দেশের। এছাড়াও প্রতিটি রপ্তানিকারকের একটি নিবন্ধন নম্বর রয়েছে। (রেজিস্ট্রেশন নম্বর)। এই কারণে, ইউএসটিআর-এর পর্যালোচনা নিয়ে আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কোনো কারণ নেই।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, মন্ত্রণালয়ের চিঠির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যালোচনার বিষয়ে আপত্তি তোলা হয়েছে। একই সঙ্গে এ বিষয়ে বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে ইউএসটিআরের কাছে সময় চাওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশের নিটওয়্যার প্রযোজক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের পর্যালোচনায় আমাদের আপত্তি আছে। তারা তৃতীয় দেশের সমীক্ষার তথ্য নিয়ে পর্যালোচনা করেছে। কোন প্রতিষ্ঠান এ ধরনের কাজ করে তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ, চীন, ভিয়েতনাম, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশ কয়েকটি দেশ এ ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িত।

তিনি বলেন, তবে ব্যবসায়ীরা অভিযোগের তদন্তে সরকারকে সহযোগিতা করবেন। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে সরকারের দেওয়া সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ।

মার্কিন বাণিজ্য সংস্থা আমেরিকান অ্যাপারেল অ্যান্ড ফুটওয়্যার অ্যাসোসিয়েশন (এএএফএ) এবং ফ্রান্সের ইউনিয়ন ডেস ফ্যাব্রিক্যান্টস (ইউএনআইএফএবি) অভিযোগ করেছে, বাংলাদেশের পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা গ্রাহকদের দ্বারা তাদের দেশে তৈরি ডিজাইন নকল করে বিভিন্ন দেশ ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেছে, যা লঙ্ঘন। মেধা সম্পত্তি আইনের। বিপরীত

গত বছরের জানুয়ারিতে সংস্থা দুটি ইউএসটিআর অফিসে অভিযোগ জমা দেয়। সেই অভিযোগের ভিত্তিতে ইউএসটিআর বাংলাদেশের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে পর্যালোচনার কথা জানিয়েছে।

এএএফএ-এর অভিযোগ অনুযায়ী, ২০২২ ভসালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ৫৬টি চালান জব্দ করা হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশে তৈরি নকল পণ্য পাওয়া গেছে। এই পরিমাণ ২০১১ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ বেশি।

তারা বলছে, ২০২২ সালে ১২টি দেশে বাংলাদেশে তৈরি নকল পণ্য আটক করা হয়েছে। এই দেশগুলির মধ্যে রয়েছে অস্ট্রেলিয়া, ইতালি, মালয়েশিয়া, ত্রিনিদাদ এবং টোবাগো, জাপান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রোমানিয়া, সৌদি আরব, জার্মানি এবং ফিলিপাইন। ২০২২ সালে, মালয়েশিয়ায় ১৭টি অভিযান চালিয়ে এক মিলিয়ন পোশাকের প্রায় দুই চতুর্থাংশ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, যার সবকটিই ছিল বাংলাদেশে উৎপন্ন নকল পণ্য।

এএএফএ, অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-এর মতে, সবচেয়ে বেশি নকল পণ্য রপ্তানি করে এমন পাঁচটি দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে রেখেছে OECD। নকল জুতা, হ্যান্ডব্যাগ এবং গহনা রপ্তানিকারকদের মধ্যেও বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অফিসের তথ্য অনুযায়ী, চীন ও তুরস্কের পর বাংলাদেশ নকল পোশাকের সবচেয়ে বড় উৎস।

এএএফএ অভিযোগ করেছে যে সঠিক নীতি কাঠামোর অভাব, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার এই ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে অনিচ্ছা এবং ব্যাপক দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশে যথাযথ মেধা সম্পত্তি সুরক্ষা ‘একদম অসম্ভব’।

তাদের মতামতে বলা হয়, ‘আমরা জানি বাংলাদেশ এলসিডি হিসেবে উন্নয়ন ও বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সমর্থন পায়। কিন্তু বাংলাদেশকে নকল পণ্য উৎপাদনকারী হিসেবে গড়ে উঠতে দিলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে যে প্রভাব পড়বে তা সংশোধনের কোনো উপায় থাকবে না।

ইউএসটিআর বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পর্যালোচনা শুরুর ঘোষণা দিয়েছে এবং বলেছে যে এই বিষয়ে একটি উন্মুক্ত শুনানি অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে ১৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশকে ব্যাখ্যা দিতে বলা হয়েছিল।

বাংলাদেশ চিঠিটি দেরিতে পাওয়ায়, ১৩ ফেব্রুয়ারি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, শুল্ক ও আবগারি অধিদপ্তরের প্রতিনিধিদের সাথে একটি বৈঠক করে।

বৈঠকে অংশ নেওয়া BKMEA-এর নেতা মোহাম্মদ হাতেম বলেন, “এখনও কোনো ক্রেতা সংগঠন আমাদের কাছে এ ধরনের অভিযোগ করেনি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের কার্যালয়ের কয়েকটি সংস্থা বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশে অভিযোগ করেছে। সেসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশও রয়েছে। একমাত্র এলডিসি রাষ্ট্র।

মোহাম্মদ হাতেম বলেন, তারা তিনটি শাস্তিমূলক সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রথমত, মার্কিন বাজার বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে শুল্ক বাড়াতে পারে; দ্বিতীয়ত, তারা বাংলাদেশের রপ্তানিতে কোটা দিতে পারে; তৃতীয়ত, এটি বাংলাদেশি তৈরি পোশাক নিষিদ্ধ করতে পারে। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ এ ধরনের শাস্তির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা নেই।

এ বিষয়ে ১৩ ফেব্রুয়ারি বৈঠক করার পাশাপাশি সরকারের গৃহীত উদ্যোগের কথা ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অভিযোগের বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান তুলে ধরে বিস্তারিত প্রতিবেদন দিতে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সময় চাওয়া হয়েছে।

admin_bhashwakar

Learn More →

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *